অর্জুন ছালের উপকারিতা কি জানলে অবাক হতে পারেন। সৃষ্টিকর্তার দেয়া উপহার ভেষজ গাছ আমাদের চারপাশে অবহেলায় বড় হচ্ছে। অথচ এগুলো আমাদের শরীরের বিভিন্ন রোগের ঔষধ। আসুন জেনে নিই অর্জুন ছালের উপকারিতা ও খাওয়ার নিয়ম।
অর্জুনের বৈজ্ঞানিক নাম: Terminalia arjuna পরিবার: Combretaceae
অর্জুন গাছের পরিচিতি
অর্জুন একটি পত্রঝরা মাঝারি ধরনের বৃক্ষ। পরিণত বয়সে একটি গাছ ১০-১৫ মিটার লম্বা হয়ে থাকে। গাছের কাণ্ড একাধিক ভাঁজ বা স্তর যুক্ত। বাকল পাতলা স্তরে বিভক্ত। পাতা লম্বাটে কম বেশি ৭.৫ সে.মি, ফুল হলুদাভ ও স্পাইক সোজা এবং ফুলের পাপড়ি নাই। ফল লম্বাটে ৫টি ভাজ ও পাখায় বিভক্ত।
অর্জুনের ঔষধি গুণাগুণ
অর্জুনের প্রধান ব্যবহার হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীদের। অর্জুন ছালের রস হৃদরোগ এবং হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধ করে। ছালের রস ব্লাডপ্রেসার এবং কোলেস্টেরল লেভেল কমায়। অর্জুনের ছাল বেটে রস খেলে হৃদপিন্ডের পেশি শক্তিশালী হয় এবং হৃদযন্ত্রের ক্ষমতা বাড়ে।
অর্জুন ছালের রস খাওয়ার নিয়ম
অর্জুনের ছালের কাঁচা রস দুধের সাথে মিশিয়ে রোজ সকালে খেতে হয়।
অর্জুন ছালের কাঁচা রস না থাকলে শুকনো বাকলের গুঁড়া ১-২ গ্রাম দুধের সাথে মিশিয়ে সকালে খালিপেটে খেতে হবে।
নিম্ন রক্তচাপ থাকলে অর্জুনের ছালের রস সেবনে উপকার হয়। রক্তক্ষরণে ৫-৬ গ্রাম ছাল রাতে পানিতে ভিজিয়ে রেখে সকালে ছেকে পানিটা খেলে আরোগ্য হয়।
হাঁপানিতে অর্জুন ফল
হাঁপানিতে অর্জুন ফল টুকরো করে তামাকের মত ধোঁয়া টানলে উপকার হয়। কাঁচা পাতার রস সেবনে আমাশয় রোগ ভাল হয়।
হৃদপিণ্ডের দুর্বলতা ও সাধারণ দুর্বলতায় ৩-৪ গ্রাম অর্জুন ছালচূর্ণ প্রত্যহ দুবার এক গ্লাস পরিমাণ দুধসহ সেব্য । এক মাস নিয়মিত সেবন করে যাওয়া আবশ্যক।
কাচাঁ অর্জুনের ছাল ৫ গ্রাম পরিমাণ নিয়ে ভালোভাবে পিষে ঠাণ্ডা পানি মিশিয়ে দিনে দুবার খেলে রক্ত আমাশয়ে বিশেষ উপকারী।
যাদের প্রস্রাবের সঙ্গে Puscell বা পুঁজ বেশী যায়, তাঁরা ৩/৪ গ্রাম শুকনো অর্জুন ছাল আধপোয়া আন্দাজ গরম জলে ৪/৫ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে ছেঁকে তার সঙ্গে একটু রান্না করা বার্লি মিশিয়ে খেলে চলে যাবে।
শরীরে ক্ষত বা ঘা হলে, খোস-পাঁচড়া দেখা দিলে অর্জুনের ছালের ক্বাথ দিয়ে ধুয়ে ছালের মিহি গুঁড়া পানি দিয়ে মিশিয়ে লাগালে দ্রুত ঘা সেরে যায়।
কান ব্যথায় অর্জুন পাতার রস
কানের ব্যথায় অর্জুন ব্যবহার করা হয়। কচি পাতার রস কানের ভিতরে দুই ফোঁটা করে দিলে কানের ব্যথা ভালো হয়।
এ্যাজমা রোগীর জন্য অর্জুন পাউডার
অর্জুন ছালের পাউডার ১২ গ্রাম দুধের ক্ষীর বা পায়েসের সাথে মিশিয়ে খেলে অ্যাজমা আক্রান্ত ব্যক্তির অ্যাজমা রোগের স্থায়ী সমাধান হবে।
অর্জুন ছালের গুঁড়া, বাসক পাতার রসে ভিজিয়ে শুকিয়ে রাখতেন প্রাচীন বৈদ্যেরা। দমকা কাশি হতে থাকলে একটু ঘি ও মধু বা মিছরির গুঁড়া মিশিয়ে খেতে দিতেন। এতে কাশির উপকার হতো।
অর্জুন ছাল ও রসুন বেটে অল্প গরম করে মচকানো জায়গায় লাগিয়ে বেঁধে রাখলে সেরে যায়। তবে সেই সাথে অর্জুন ছালের চূর্ণ ২-৩গ্রাম মাত্রায় আধা চামচ ঘি ও সিকি কাপ দুধ মিশিয়ে অথবা শুধু দুধ মিশিয়ে খেলে আরও ভালো হয়।
ত্বকের যত্নে অর্জুন ছালের পাউডার
ত্বকে ব্রণের ক্ষেত্রে অর্জুন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ছালের চূর্ণ মধুর সাথে মিশিয়ে ব্রণের উপর লাগালে খুব দ্রুত উপকার হয়। এছাড়া ছালের মিহি গুঁড়া মধু মিশিয়ে লাগালে মেচতার দাগ দূর হয়।
যাদের বুক ধড়ফড় করে অথচ উচ্চ রক্তচাপ নেই, তাদের পক্ষে অর্জুন ছাল কাঁচা হলে ১০-১২ গ্রাম, শুকনা হলে ৫-৬ গ্রাম একটু ছেঁচে ২৫০ মিলি দুধ ও ৫০০ মিলি পানির সাথে মিশিয়ে জ্বাল দিয়ে আনুমানিক ১২৫ মিলি থাকতে ছেঁকে বিকাল বেলা খেলে বুক ধড়ফড়ানি অবশ্যই কমবে। তবে পেটে যেন বায়ু না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
মাঝে মাঝে কারণে বা অকারণে চোখে রক্ত ওঠে বা পড়ে। সেক্ষেত্রে ৪-৫ গ্রাম ছাল রাতে পানিতে ভিজিয়ে রেখে সকালে ছেঁকে নিয়ে পানিটা খেলে উপকার পাওয়া যায়।
উপরোক্ত মাত্রায় ছাল ভিজানো পানি আধচামচ ও সমপরিমাণ কাঁচা হলুদের রস মিশিয়ে খেলে শ্বেত বা রক্তপ্রদর উপশম হয়।
এই ছাল মুখ, জিহ্বা ও মাড়ির প্রদাহের চিকিত্সায় ব্যবহৃত হয়, এটি মাড়ির রক্তপাত বন্ধ করে।
অর্জুন ছালের গুড়ো ৪/৫ গ্রাম আধপোয়া আন্দাজ গরম পানিতে ৪/৫ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে। তারপর ছেঁকে ঐ পানির সাথে আন্দাজ ১ চামচ শ্বেতচন্দন ঘষে মিশিয়ে খেলে শুক্রমেহে (Spermatorrhoea) উপকার হয়।
যাদের মধ্যে যৌন অনীহা (Lack of Libido) দেখা দেয় তাদের ক্ষেত্রে অর্জুনের ছাল চূর্ণ উপকারী। এই ছাল চূর্ণ দুধের সাথে মিশিয়ে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে নিয়মিত খেলে এই রোগ দূর হয়।
অর্জুন ছাল ভিজিয়ে খেলে কি উপকার হয়
অর্জুন গাছের ছাল পানিতে ভিজিয়ে রোজ সকালে খালি পেটে খেলে- গ্যাষ্ট্রিক ও শ্বাসকষ্টে খুব উপকার হয়। সেই সাথে বুকের ধরপরানি, রক্তেরচাপ নিয়ন্ত্রণে ভুমিকা রাখে। হার্টের শক্তি বৃদ্ধি করে, ধমনির শিরাগুলিকে পরিস্কার রাখতে সহায়তা করে, ফলে হার্টঅ্যাটাকের ঝুঁকি থেকে বাঁচাতে সাহায্য করে।
অর্জুনের ছাল তুলার নিয়ম কি
একটি পূর্ণ বয়স্ক অর্জুন গাছ থেকে ৪ ইঞ্চি চ্যাপ্টা করে, এক সাইট থেকে ছাল তুলতে হবে। এবং অন্য সাইট রেখে দিতে হবে, যেন গাছের তেমন ক্ষতি না হয়। এগুলো শেষ হলে আবার বাকি সাইট থেকে তুলে সংগ্রহ করতে পারবেন। এরপর এগুলোকে ছোট ছোট টুকরা করে কেটে ধূয়ে রোদে শুকিয়ে নিবেন। তারপর ৩-৪ টুকরো অর্জুনের ছাল ১ গ্লাস পানিতে রাতে ভিজিয়ে রাখবেন। সকালে খালি পেটে পানিটুকু খেয়ে আবার পানি দিয়ে রাখবেন। এই পানি আবার সন্ধ্যায় খাবেন।
দাঁত গোড়া ফুলে গেলে
দাঁত নড়া, দাঁত দিয়ে রক্ত পড়া, ঠান্ডা বা গরম পানিতে দাঁত শিরশির করা, দাঁতের গোড়া ফুলে যাওয়া, মুখের দুর্গন্ধসহ যাবতীয় দন্তরোগের ক্ষেত্রে অর্জুন ফল,অর্জুন ছাল, নারিকেল গাছের নতুন শিকড় সবগুলো একত্রে জাল দিয়ে গাদ তৈরি করে নিতে হবে। তারপর এতে সামান্য পরিমাণ কর্পূর মিশিয়ে প্রত্যহ দু’বার ওই দ্রবণ মুখের ভেতর গড়গড়া করলে দন্তরোগ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়।
দন্তরোগের মহৌষধ
এছাড়াও ২০০ গ্রাম অর্জুন ছাল চূর্ণ, ২০ গ্রাম লবঙ্গ, ২০ গ্রাম কাবাব চিনি, ৫০গ্রাম নিমের ছাল, ৫০ গ্রাম নারিকেল গাছের শিকড়, ১ গ্রাম কর্পূর, ১ গ্রাম পিপারমেন্ট সবগুলো উপাদান একত্রে মিশিয়ে পাউডার প্রস্তুত করে নিয়মিত সকাল ও রাতে দাঁত ব্রাশ করলে দন্তরোগ থেকে সম্পূর্ণরূপে আরোগ্য হওয়া যায়।
অর্জুন গাছের ছালের উপকারিতা
ডায়রিয়া বা পেটের অন্য কোনো সমস্যা দেখা দিলে অর্জুনের ছাল ৪৫-৩০ গ্রাম করে খেলে হজম ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় ও অসুবিধা দূর হয়। মুখ, জিহ্বা ও মাড়ির প্রদাহে অর্জুনের ছাল এসব রোগের চিকিত্সায় ব্যবহৃত হয়। এটি মাড়ির রক্তপাতও বন্ধ করে।
এছাড়াও এর রয়েছে অনেক ঔষধিগুণ। ইদানিং অর্জুন গাছের ছাল থেকে ‘অর্জুন চা’ তৈরি হচ্ছে যা হৃদরোগের জন্য অত্যন্ত কার্যকরী। অর্জুনের পাউডার পানিতে ফুটিয়ে মধু অথবা আখের গুড় মিশিয়ে চা পানে হার্ট সুস্থ ও সবল হয়। হৃদরোগের ঝুঁকি কমে।
অর্জুন গাছের জন্ম কোথায়
বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা অর্জুনের আদিনিবাস। বাংলাদেশের সর্বত্রই পাওয়া যায়। ঔষধি গাছ অর্জুন নিচু ও স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় ভাল জন্মায়।
হারবাল ষ্টোরে যোগাযোগ করলে শুকনো অর্জুনের ছালের পাউডার সংগ্রহ করতে পারবেন। অথবা এই সাইটের সেল সেন্টারে নক করতে পারেন। অন্য কোন বিষয়ে জানতে চাইলে কমেন্ট করে জানাবেন।
অর্জুনাকার্ড সিরাপ কেন খায়
একমি ল্যাবরেটরীজ এর হারবাল গ্রুপের একটি ঔষধের নাম অর্জুনাকার্ড। যা এ্যাজমা, হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, বুক ধরপর, হৃদযন্ত্রের দূর্বলতা, হৃদরোগ জনিত শ্বাসকষ্ট ও হৃদপিন্ডের শক্তিবর্ধক হিসাবে কার্যকর। ২-৩ চামচ ঔষধ দিনে ৩ বার, ২-৩ মাস সেবনে চমৎকার উপকার হয়। অর্জুনাকার্ড সম্পুর্ন ভেষজ ঔষধ, তাই এর কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নাই।
হারবাল ঔষধ অর্জুনারিষ্ট
হারবাল অর্থাৎ আয়ুর্বেদিক ঔষধ এর একটি জনপ্রিয় ঔষধের নাম হলো- অর্জুনারিষ্ট। ৯০ এর দশক পর্যন্ত এতো জনপ্রিয় ছিল যে, শক্তি, এপি, মোজাহের, সাধনা ঔষধালয় সহ বেশ কিছু জনপ্রিয় আয়ুর্বেদিক কোম্পানির অর্জুনারিষ্টের সাপ্লাই সর্ট পরে যেতো। রোগীদের ধৈর্য কমে যাওয়ায় এসব ঔষধ আর এখন তেমন একটা দেখা যায়না। তবে, আমার বিশ্বাস আবার সবাইকে ভেষজ ঔষধের দিকে ফিরে যেতে হবে।
আরও পড়ুন – হস্তমৈথুন থেকে বাঁচার উপায় জেনে নিন
ধন্যবাদ এই হারবাল ঔষধ টির গুণাবলী পড়ে খুবই ভাল লাগল